মার্কো পোলো

মার্কো পোলোঃ একজন ইউরোপীয় পর্যটকের এশিয়া বিজয়ের কাহিনি

মার্কো পোলো (১২৫৪ – ১৩২৪ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন ইতিহাস বিখ্যাত পর্যটক, ব্যাবসায়ি এবং লেখক। তিনি ইতালির ভেনিস নগরে জন্মগ্রহন করেন। তিনি চীন, বার্মা, ইন্দোনেশিয়া ও পারস্য সহ এশিয়ার অনেক দেশ ভ্রমণ করেন যে সময় এই অঞ্চল গুলো সাধারন ইউরপিয়দের কাছে অনেকটাই অচেনা এবং রহস্যাবৃত ছিল। The Travels of Marco Polo/ The Book of Marvels বা মার্কো পোলোর ভ্রমণ কাহিনি নামক গ্রন্থে তাঁর এই ভ্রমণ কাহিনি সবই লিপিবদ্ধ করা আছে। এখান থেকে আমরা জানতে পারি তৎকালীন চীন সাম্রাজ্য, তার রাজধানী পিকিং এবং অন্যান্য এশিয়ান সাম্রাজ্য সম্পর্কে।


জন্ম ও বংশ পরিচয়

মার্কো পোলোর গল্প বলতে গেলে শুধু মার্কো পোলোর কথা বললে হবে না, তাঁর গৌরবময় ভ্রমণ কাহিনির সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে আরও দুটি নাম। মার্কো পোলোর পর্যটক হবার বিষয়টি অনেকটাই বংশগত। তাঁর বাবা নিক্কলো পোলো এবং চাচা মাত্তেও (মতান্তরে মাফেও) পোলো ছিলেন বিখ্যাত পর্যটক এবং ব্যাবসায়ি। মার্কো পোলোর শিশুকালেই তারা দুইজন এশিয়া ভ্রমণ করেন এবং বিখ্যাত মঙ্গলিয়ান সম্রাট কুবলাই খান এর সাথে দেখাও করেন। সেই হিসেবে মার্কো পোলো প্রথম ইউরপিয় নন যিনি সুদুর এশিয়া ভ্রমণ করেন। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে মার্কো পোলোর এত খ্যাতির রহস্য কি? এর উত্তর পেতে হলে তাঁর ভ্রমণ সম্পর্কে জানতে হবে। মার্কো পোলোর সাথে আমাদেরও হয়ে উঠতে হবে ত্রয়োদশ শতাব্দির অদম্য পর্যটক, যারা অজানাকে জানার জন্যও যেকোন ঝুকি নিতেও প্রস্তুত ছিলেন।


মার্কো পোলোর ছেলে বেলা সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। তাঁর বাবা যখন ভ্রমনে ছিলেন, তখন তাঁর জন্ম হয়। জন্মের কিছুকাল পরেই তাঁর মা মারা যায় এবং চাচা চাচির কাছে তিনি মানুষ হন। তাঁরা তাঁকে ব্যাবসায়ি এবং পর্যটক হবার জন্যও প্রয়োজনীয় সব শিক্ষায় শিক্ষিত করেন। ফলে অতি অল্পসময়ের মধ্যেই মার্কো বৈদেশিক বানিজ্য, বৈদেশিক মুদ্রা, ভূগোল এবং জাহাজ চালনার মত বিষয় গুলোতে দক্ষতা অর্জন করেন।


ভ্রমণ ও উদ্দেশ্য

১২৬৯ সালে মার্কো পোলোর বাবা এবং চাচা ভেনিস প্রত্যাবর্তন করেন। ১৫ বছর বয়সী মার্কো সেটাই ছিল বাবার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ। এর দুই বছর পর ১২৭১ সালে বাবা এবং চাচার সাথে ১৭ বছর বয়সী মার্কো বেরিয়ে পরেন এক দুঃসাহসী অভিযানে। এই অভিযানের বর্ণনা পরবর্তীতে মার্কোর লেখায় চমৎকার ভাবে ফুটে ওঠে।


নিক্কলো পোলো এবং চাচা মাত্তেও পোলো এই অভিযানটি শুরু করেন মুলত কুবলাই খানের একটি অনুরোধ রাখতে গিয়ে।  মঙ্গোলীয় সম্রাট কুবলাই খান এর আগে নিক্কলো এবং মাত্তেও কে অনুরোধ করেন একটি দুষ্প্রাপ্য বস্তু তাঁকে এনে দেয়ার জন্য। সেটি হল ‘ক্রিজম’ বা জেরুজালেমের পবিত্র তেল। খ্রিস্টান ধর্মে এই তেল কে অনেক পবিত্র, দুস্প্রাপ্য এবং মর্যাদা সম্পন্ন হিসেবে দেখা হত। এই তেল সংগ্রহ পোলোদের অভিযানের মুল উদেশ্য হলেও একমাত্র নয়। ভ্রমণ এবং অভিযানপ্রিয় পোলোদের উদেশ্য ছিল যতটা সম্ভব এশিয়া এবং আসে পাশের এলাকা গুলো ঘুরে দেখা এবং সেই সাথে কিছু বাণিজ্যও করা।


চীনের উদ্দেশ্যে যাত্রা

চীন ভ্রমণের উদ্দেশ্যে প্রথমে পোলোরা নৌপথে অ্যাক্রি (বর্তমান ইসরায়েল) এ যান। এরপর উটের পিঠে করে হরমুজ প্রনালী পর্যন্ত পৌছায়। পোলোদের ইচ্ছা ছিল সরাসরি চীন যাবার। কিন্তু হরমুজ প্রণালীতে তাঁরা যে জাহাজগুলো পায় সেগুলা সমুদ্র যাত্রার উপযোগী ছিল না। তাই তাঁরা বাধ্য হয়ে সড়ক পথই বেছে নেয়। তাঁরা বিখ্যাত সড়ক সিল্ক রোড ধরে যাত্রা শুরু করে। দীর্ঘ কষ্টকর পথ অতিক্রম করে অবশেষে তাঁরা সাংডুতে (বর্তমান ঝাঞ্জিয়াকু) পৌঁছান। এখানেই ছিল কুবলাই খানের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ। এখানে পৌছাতে পোলোদের বিস্তর ঝামেলা পোহাতে হয়। যেমন একবার পোলোরা  এক দল ব্যাবসায়িদের সাথে যাচ্ছিলো। পথিমধ্যে একদল ডাকাত তাদের আক্রমন করে বসে। ডাকাতরা অদ্ভুত এক উপায়ে ধূলিঝড়কে আড়াল হিসেবে ব্যাবহার করে আক্রমন করে। তারা অনেক ব্যাবসায়িকে মেরে ফেলে এবং অনেককে বন্দী করে। পোলোরা সেযাত্রা কোনোমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাচে।


অবশেষে ভেনিস থেকে রওনা হবার সাড়ে তিন বছর পর পোলোরা কুবলাই খানের প্রাসাদ এ পৌঁছায়। তাদের পৌঁছানোর সঠিক সময় নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। ঐতিহাসিকদের মতে ১২৭১ থেকে ১২৭৫ এর মধ্যে যেকোনো সময় পোলোরা ইউওান রাজদরবারে পৌঁছান এবং পবিত্র ক্রিজম তেল এবং পোপদের চিঠিগুলো রাজদরবারে হস্তান্তর করেন।


মার্কো পোলো এবং কুবলাই খান

এরপর তারা বেশ লম্বা সময় চীনে অবস্থান করেন। মার্কো পোলো নিজে চারটি ভাষায় কথা বলতে পারতেন। মার্কো এবং তাঁর সফর সঙ্গিরা দীর্ঘদিনের ভ্রমণের ফলে বিস্তর অভিজ্ঞতাও অর্জন করে ফেলেছিলেন। তাই তাঁরা চীনা রাজদরবা্রে যথেষ্ট সম্মানিত এবং সমাদৃত ছিল। কেউ কেউ মনে করেন মার্কো পোলোকে উচ্চ পদেও বহাল করা হয়েছিল। যাইহোক, তাঁরা চীনের বেশিরভাগ অংশই ঘুরে দেখেন। বিশেষ করে দক্ষিণ এবং পূর্ব চীন ও বার্মার অনেক বর্ণনা পাওয়া যায় তাঁর লেখায়।


চতুর সম্রাট কুবলাই খান ভাবলেন যে পোলোদের এই অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগানো যেতে পারে। তাই তিনি পোলোদের চীন ত্যাগের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করলেন। কুবলাই খানের বয়স হয়ে গিয়েছিল। পোলোরা ভাবলেন যে যদি কুবলাই খান মারা যান, তাহলে তাঁর বিপক্ষের লোকজন পোলোদের জন্যও সমস্যা হয়েও দাড়াতে পারে। পোলোদের রাজদরবারের জনপ্রিয়তা স্বাভাবিকভাবেই অনেকের ঈর্ষার কারণ হতেই পারে। এতে তাঁরা বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন।


চীন ত্যাগ

অবশেষে ভাগ্যদেবী সুপ্রসন্ন হয় ১২৯২ সালে। সে বছর কুবলাই খানের জ্ঞাতি ভাই, পারস্যের অধিপতি বিবাহের পাত্রী খোজার জন্য একদল সভাসদ প্রেরন করেন চীনে। তারা পোলোদের অনুরোধ করেন যেন তারা ফিরতি পথে সভাসদদের দলটি কে সঙ্গ দেয়। অবশেষে পোলোরা চীন ত্যাগ করার একটা চমৎকার সুযোগ পেয়ে যায় এবং পারস্য যাবার জন্যে এক বাক্যে রাজী হয়ে যায়। সেই বছরেই দক্ষিণ চীনের জাইতুন নামক নগর থেকে জাহাজযোগে পোলোদের পারস্য অভিমুখে যাত্রা শুরু হয়। যাত্রার জন্য ব্যাবহার করা হয় চীনের ঐতিহ্যবাহী জলযান যার নাম জাঙ্ক।


প্রথমে কনভয়টি জাইতুন থেকে সিঙ্গাপুর পৌছায়। এর পর তাঁরা উত্তর দিকে যাত্রা শুরু করেন এবং সুমাত্রা (বর্তমান ইন্দোনেশিয়া) পৌঁছান। এরপর তাঁরা পশ্চিমে যাত্রা করেন এবং জাফনার বিখ্যাত পয়েন্ট পেদ্র তে পৌঁছান। সেখান থেকে তামিলাক্কামের পান্দায়ান বন্দর। এভাবে বিভিন্ন দেশ ঘুরে ঘুরে অবশেষে আরব সাগর পার হয়ে হরমুজ প্রণালীতে পৌঁছান। দুই বছরের সুদীর্ঘ যাত্রাটি মোটেও সুখকর কিছু ছিল না। প্রতিকুল পরিবেশ আর অসুস্থতার কারণে ছয়শত যাত্রীর পাঁচশত বিরাশি জনই মৃত্যুবরণ করেন। দীর্ঘ ভ্রমণ আর অভিজ্ঞতার কারণে আমাদের পোলোরা শারীরিক ও মানসিক ভাবে অন্যদের চাইতে বেশ শক্ত সামর্থ্য ছিলেন। তাই এযাত্রাও তাঁরা প্রানে বেচে যান। হরমুজ প্রণালীতে অবতরণের পর পোলোরা বরযাত্রীদের কাছ থেকে বিদায় নেন এবং স্থলপথে ভ্রমণ করে কৃষ্ণ সাগরের নিকটবর্তী ত্রেবিজন্দ (বর্তমান ত্রাবজন) বন্দরে পৌঁছান।


প্রত্যাবর্তন, বন্দীদশা, মুক্তি, বিবাহ এবং মৃত্যুবরন

অবশেষে ১২৭১ সালে ভেনিস ত্যাগ করার চব্বিশ বছর পর পোলোরা স্বভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন ১২৯৫ সালে। ততদিনে তাদের ২৪,০০০ কিলোোমিটারেরও বেশী ভ্রমণ করা হয়ে গেছে। দেশে ফিরে তাঁরা অবাক হয়ে দেখেন যে ভেনিসের সাথে জেনোয়ার তুমুল যুদ্ধ চলছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই তাঁরা বন্দী হন জেনোয়ার সৈনিকদের হাতে। এরপর তাদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। সম্ভবত মার্কও পোলোর বাবা এবং চাচার বন্দীদশাতেই মৃত্যু হয়।


কারাগারে থাকা অবস্থায় মার্কোর সাথে দেখা হয় পিসার বিখ্যাত লেখক রুস্তিচেলোর সাথে। তাঁকে তিনি তাঁর ভ্রমণ কাহিনি বর্ণনা করেন। রুস্তিচেলো সাথে সাথে সেগুলো লিপিবদ্ধ করতে থাকেন। মার্কো পোলো চীনে থাকার অভিজ্ঞতা অনেক বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করেন। কুবলাই খান ও তাঁর প্রাসাদের বর্ণনা ছাড়াও মার্কো তার লেখায় এমন সব জিনিস পত্রের বর্ণনা দেন যা ছিল তখনকার ইউরপিয়দের কাছে একদমই অজানা। যেমন কাগজের টাকা, কয়লা, ডাক ব্যাবস্থা এবং চশমার মত বিষয়গুলোর সাথে ইউরোপের কেউই পরিচিত ছিলেন না।


এভাবে সৃষ্টি হয় মার্কো পোলোর বিখ্যাত ভ্রমণ কাহিনীর পাণ্ডুলিপি।

১২৯৯ সালে ভেনিস ও জেনোয়ার মধ্যে শান্তি চুক্তি হয় এবং মার্কও পোলো কে মুক্তি দেয়া হয়। ভ্রমণ বাণিজ্য থেকে সংগৃহীত অর্থ ও অন্যান্য মুল্যবান দ্রব্যাদি বিক্রয় করে তিনি বেশ ধনী হয়ে যান। এরপর আর তিনি কখনই ভেনিস ছেড়ে কোথাও যাননি। ১৩০০ সালে ডোনাটা ব্যাডর কে বিয়ে করে সংসারী হন মার্কো। তাঁর তিনজন সন্তান জন্মগ্রহন করে। ১৩২৪ সালে ৭০ বছর বয়সে মার্কো পোলো মৃত্যুবরন করেন। তাঁকে ভেনিসের স্যান লরেনজো গির্জার নিকট সমাহিত করা হয়।


মার্কো পোলো অনেক বিখ্যাত একজন পর্যটক। তাঁর পূর্বে এবং পরেও অনেক পর্যটক তাঁর মত কিংবা তাঁর চাইতেও বেশী ভ্রমণ করেছেন। কিন্তু কিছ ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অন্যদের চাইতে অনেক বেশী। তাঁর প্রধান কারন তিনি তাঁর ভ্রমণের বিস্তারিত বর্ণনা অনেক চমৎকার ভাবে লিপিবদ্ধ করেন। যদিও কিছু কিছু বিষয়ের সত্যতা নিয়ে ঐতিহাসিকগণ পরবর্তীতে প্রশ্ন তুলেছেন। তারপরও, পশ্চিমাদের এশিয়া বিষয়ক তথ্য ভাণ্ডার তৈরির ক্ষেত্রে মার্কও পোলোর অবদান অনস্বীকার্য। তৎকালীন রহস্যময় এবং অজানা এশিয়ার মানচিত্র তৈরির ক্ষেত্রে মার্কও পোলোর বর্ণনা গুলোর সাহায্য নেয়া হয়। পরবর্তীতে এই মানচিত্রের উপর ভিত্তি করে ইউরোপীয় বনিকরা এশিয়া তে আসা শুরু করে। পরবর্তীতে ইউরোপীয়রা এশিয়ার প্রাচুর্যে মুগ্ধ হয়ে অভিযানও চালায়।


সুতরাং পৃথিবীর ইতিহাসে মার্কো পোলো এবং তাঁর ভ্রমণের গুরুত্ব যে অনেক বেশী, সেটা বলাই বাহুল্য।

By Rahat Muna

Thinker & Designer

Share This Post :