বাংলাদেশীদের জন্য নেপাল ভ্রমণ গাইডঃ ভ্রমণ খরচ ও দর্শনীয় স্থানসমূহ

বাংলাদেশীদের জন্য নেপাল ভ্রমণ গাইডঃ ভ্রমণ খরচ ও দর্শনীয় স্থানসমূহ

উপমহাদেশের- বিশেষত বাঙালি পর্যটকদের কাছে নেপাল ঘুরতে যাওয়ার আদর্শ জায়গা। নেপালের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভৌগলিক বৈচিত্র্য একে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় ও কৌতূহলপ্রদ করেছে। দেশটির মধ্যে এক ধরনের ধ্যানমগ্নতা রয়েছে যা আপনার আত্মাকে জাগিয়ে তোলে। নেপাল ভ্রমণকারীরা দেশটির সৌন্দর্য ও বিশালত্বে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েন।


“নেপাল” শব্দটা শুনলে প্রথমেই আমাদের মাথায় যা আসে তা হলো হিমালয় ও মাউন্ট এভারেস্ট- পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। নেপাল বৃহদায়তন হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত। নেপালের মানুষ শান্ত, নম্র ও স্থির প্রকৃতির। নেপালি ভাষায় বাংলা, হিন্দি, সংস্কৃত অনেক শব্দ আছে। নেপালিরা মূলত হিন্দিতে কথা বলে। 


প্রতি বছর ঝাঁকে ঝাঁকে পর্যটকেরা নেপাল ঘুরতে আসেন হিমালয় দেখতে ও ট্রেকিং করতে। এছাড়া এখানকার মন্দির ও বুদ্ধস্তুপগুলোও নেপালের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। কাঠমান্ডুতে ২ দিন, পোখারাতে ২ দিন, নাগরকোটে ২ দিন এবং চিতওয়ান পার্কে সাফারির জন্যে ১ দিন– মোট ৭ দিন হাতে রেখে নেপাল যাওয়া উচিত।


এই ব্লগে আমরা চেষ্টা করবো আপনার জন্য নেপাল ভ্রমণ খরচ ও দর্শনীয় স্থানগুলো মিলিয়ে একটা পরিপূর্ন নেপাল ভ্রমণ গাইড তৈরি করে দিতে যাতে আপনার নেপাল ভ্রমণ সহজ ও সাশ্রয়ী হয়। তো চলুন শুরু করা যাক। 


নেপাল ভ্রমণ গাইড ও নেপাল ভ্রমণ খরচ



নেপালে সার্কভুক্ত দেশ তথা বাংলাদেশিদের জন্য বিনামূল্যে অন-এরাইভাল ভিসার ব্যবস্থা আছে। নেপালের ভিসা পেতে আপনাকে নেপাল এমব্যাসির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে গিয়ে অন-এরাইভাল ভিসা এপ্লিকেশন ফর্ম পূরন করতে হবে। ফর্ম পূরনের সময় আপনাকে নিম্নোক্ত ডকুমেন্টগুলো আপলোড করতে হবে-


  • পাসপোর্ট সাইজ ছবি

  • জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্ম সনদ

  • পাসপোর্ট 

  • সুপারিশপত্র (যদি থাকে) 


সাধারণত ১ দিন লাগে নেপালের ভিসা পেতে। নেপালে যাওয়ার দুটি পদ্ধতি আছে– বাই রোড অথবা বাই এয়ার। বাই রোডে খরচ কম কিন্তু কোভিডের কারণে নেপাল ভ্রমণ বাই রোডে বন্ধ আছে। প্লেনে নেপাল যেতে হলে ১৭,৫০০ থেকে ভাড়া শুরু। ঢাকা থেকে নেপাল বিমানের সাশ্রয়ী টিকেট পাওয়ার জন্য কমপক্ষে এক মাস আগে টিকেট কেটে রাখলে ভাড়া অনেক কম পড়বে। ঢাকা থেকে নেপাল যেতে দেড় ঘন্টার মতো লাগে।


ধরি আপনি কাঠামান্ডু ত্রিভুবন এয়ারপোর্টে নামলেন। ইমিগ্রেশনে যাওয়ার সময় হাতে করে নিম্নোক্ত ডকুমেন্টগুলো নিয়ে যেতে হবেঃ 


  • রিটার্ন প্লেন টিকেট

  • ট্যুর প্ল্যান (হোটেল বুকিং এর কাগজ)

  • পাসপোর্ট


ইমিগ্রেশন পার হওয়ার পর অল্প কিছু ডলার এক্সচেঞ্জ করে নিন বিমানবন্দরের মানি এক্সচেঞ্জ বুথ থেকে। বিমানবন্দরে সাধারণত রেট কম দেয় তাই খুব বেশি টাকা এক্সচেঞ্জ করার দরকার নেই। শহর থেকে বাকিটা করে নেবেন। বিমানবন্দরের বুথে ভারতীয় রুপি এক্সচেঞ্জ করে না। মানি এক্সচেঞ্জ করার পর নেপাল টেলিকমের একটা সিম কিনে নিন। ৫০০ নেপালি রুপি পড়বে সিমের দাম।


নেপাল ভ্রমণ গাইডঃ নেপালের দর্শনীয় স্থানসমূহ


নেপালের দর্শনীয় স্থানসমূহ নিম্নরুপঃ


কাঠমান্ডু



নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু এর মন্দির, মঠ, ও বুদ্ধস্তুপের জন্য বিখ্যাত। সমগ্র নেপালের মধ্যে শুধু কাথমান্ডুতেই আছে ৫টি “বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান” যথা– দরবার স্কয়ার, বৌধনাথ স্তুপা, পশুপতিনাথ মন্দির, ও স্বয়ম্ভূনাথ স্তুপা। এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪,৩৪৪ ফুট ওপরে অবস্থিত এবং নেপালের সবচেয়ে জনবহুল শহর। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে এখানে মানুষের বাস। 


কাঠমান্ডুকে হিমালয়ের প্রবেশপথ বলা হয়। এশিয়ার অন্যতম দ্রুত ক্রমবর্ধমান বহুজাতিক শহর কাঠমান্ডু উপত্যকা। এখানে হিন্দু ও বৌদ্ধ দুই ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বাস করে এবং তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠাণ কাঠমান্ডুর সংস্কৃতির একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে। 


কাঠমান্ডু সম্পূর্ণটা ভালোভাবে ঘুরে দেখতে হলে এখানে কমপক্ষে দুই রাত দুই দিন কাটানো উচিত। এখানকার হোটেলগুলো মোটামুটি। ট্যুরিস্ট এরিয়া বলে খরচ তুলনামূলক অন্য শহরগুলোর চেয়ে একটু বেশি। সোলো ট্রাভেলারদের জন্যে এক হাজার টাকায় রাত কাটানোর মতো হোটেল আছে। একটু খুঁজলে আপনার বাজেটের মধ্যেই হোটেল পেয়ে যাবেন। 


কাঠমান্ডুতে হালাল খাবার খেতে হলে আলহামদুলিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ হোটেলে যেতে পারেন। নেপালের খাবারের সাথে আমাদের বাংলাদেশি খাবারের অনেক মিল আছে। তাই নেপালে খাবার নিয়ে খুব একটা সমস্যা হবে না। যেকোন দোকানে ঢুকে “নেপালি থালি” অর্ডার করে দিলে ঠকবেন না। নেপালি থালিতে ভাত, ডাল, শাক, সবজির তরকারি ও অর্ডার অনুযায়ী মুরগী বা খাসির মাংস থাকে। 


দরবার স্কয়ার



নেপালের রাজপ্রাসাদের ঠিক উল্টোদিকেই অবস্থিত কাঠমান্ডু দরবার স্কয়ার। এখানে অনেকগুলো মন্দির, মূর্তি, আর খোলা উঠান আছে। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা তাদের ধর্মীয় উৎসবের কাজে এ জায়গাটি ব্যবহার করে থাকে। রাজ-রাজড়াদের আমলে জনসাধারণের একত্র হওয়ার জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হতো দরবার স্কয়ার। এখানে রাজকীয় অনুষ্ঠান যেমন রাজ্যাভিষেক, বিয়ে, পূজা-মন্ত্রপাঠ হতো।


২০১৫ সালে ভয়াবহ নেপাল ভূমিকম্পে দরবার স্কয়ারের বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ভেঙ্গে গুড়ো গুড়ো হয়ে যায়। তার মধ্যে কিছু পুনরুদ্ধার করা গিয়েছে কিন্তু বেশিরভাগ পুনরুদ্ধারের কাজই ধীরলয়ে চলছে।


বৌধনাথ স্তূপ



ঐতিহাসিকগণের মতে, ১৪ শতকে বুদ্ধের মৃত্যুর পর বৌধনাথ স্তূপ নির্মীত হয়। এটিকে বৌদ্ধ ধর্মের আলোকবর্তিকা বলা হয়। এর গঠন ও কারুকার্য শান্তি ও সৌহার্দ্যের বার্তা বয়ে আনে। বৌধনাথ স্তূপ যে এলাকায় অবস্থিত তা এককালে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা ছিলো। জাহাজ থেকে নেমে দেশ-বিদেশের বণিকরা এই এলাকা দিয়েই যাওয়া আসা করতো। তাদের ধর্মান্তরিত করতে সাহায্য করার উদ্দেশ্য নিয়েই প্রধানত স্তূপটি তৈরি করা হয়।


স্থাপনাটি দেখলে সবার আগে চোখে পড়ে একটি বিশাল গম্বুজ। তার ওপর রয়েছে পিরামিড আকৃতির টাওয়ার। গম্বুজ ও টাওয়ার এর মাঝখানে চারকোণা বাক্স যার চার দিকে ৪ জোড়া চোখ বুদ্ধের সর্বদর্শীতাকে প্রতিনিধিত্ব করে। এই পুরো স্তাপনাটি দাঁড়িয়ে আছে একটি মান্ডালার ওপর। বৌদ্ধ তন্ত্রবাদে মান্ডালা একটি প্রতীকী চিত্র যা পবিত্র আচার সম্পাদনে এবং ধ্যানের একটি উপকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।


পশুপতিনাথ মন্দির



হিন্দু দেবতা পশুপতি অথবা শিবকে উৎসর্গ করে বানানো হয়েছে পশুপতিনাথ মন্দির। পশুপতি নেপালের জাতীয় দেবতা। পশুপতিনাথ মন্দির সৌন্দর্য্যের দিক থেকে নেপালের হিন্দু স্থাপনাশৈলীগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি ইউনেস্কোর “বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান” এর মর্যাদা পেয়েছে। মন্দির এলাকাইয় প্রচুর সাধু, পন্ডিত, মৃত অথবা মৃতপ্রায় মানুষ, সৎকারকার্যে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ, বানর, হরিণ ও পর্যটকের দেখা পাওয়া যায়। 


প্রতি বছর শত শত বয়স্ক হিন্দু ভীড় করেন পশুপতিনাথ মন্দিরে। তারা বিশ্বাস করেন যে এই মন্দিরে মারা গেলে পরের জন্মে তারা মানুষ হিসেবেই জন্মাবেন। তাই অসুস্থু, মৃতপ্রায় ব্যক্তিগণ জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ফেলতে এই মন্দির প্রাঙ্গনে চলে আসেন। তারপর এখানেই তাদের শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয় ও বাগমতি নদী যা কিনা গঙ্গার শাখা নদী- তাতে তাদের দেহাবশেষ ছিটিয়ে দেয়া হয়।


স্বয়ম্ভূনাথ স্তূপ 



স্বয়ম্ভূনাথ স্তূপ কাঠমান্ডু ভ্যালীতে অবস্থিত। এটি কাঠমান্ডু ভ্যালীকে ওপর থেকে পর্যবেক্ষণ করে ও পর্যটকদের ৩৬০-ডিগ্রী প্যানারমিক ভিউ দেয়। স্বয়ম্ভূনাথ বৌধনাথ এর পর নেপালের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্তূপ। আশেপাশে অনেক বানর থাকায় কিছু কিছু ট্যুরিস্ট একে “মাঙ্কি টেম্পল” বা “বানরের মন্দির” বলেও ডাকে। এই স্তূপটি নেপালের অন্যতম পুরোনো একটি স্থাপনা যা প্রায় ২০০০ বছর আগে নির্মীত হয়েছিলো। স্তূপ এলাকার মধ্যে অসংখ্য পবিত্র গুপ্তস্থান ও মঠ রয়েছে।


এদের মধ্যে জনপ্রিয়–


থামেল



থামেল কাঠমান্ডু শহরে অবস্থিত। রাতের থামেল কাঠমান্ডুর একটি বিখ্যাত পর্যটন স্পট। থামেলের সুন্দর রাস্তাগুলোর দুই পাশে সারি সারি দোকান থেকে আপনি ইচ্ছামতো কেনাকাটা করতে পারবেন। থামেলে প্রচুর নাইটক্লাব, রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে, ও বার আছে। থামেলের পথ ধরে হাটতে হাটতে অন্যান্য বাঙালি পর্যটকদের সাথে দেখা হয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। সবাই রাতের খাবারটা এখানেই খেয়ে নেয়।


চন্দ্রগিরি পাহাড়



কাঠমান্ডু থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চন্দ্রগিরি পাহাড়। এর প্রধান আকর্ষন কেবল কার রাইড। দূর দূরান্ত থেকে পর্যটকেরা এখানে ৩০০০ ফুট উচু চন্দ্রগিরি পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত কেবল কারে করে চড়তে আসে। কেবল কারে করে পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার সময় চোখে পড়ে পাহাড়ের আশেপাশের অপরুপ দৃশ্য। কেবল কারের চারপাশ দিয়ে মেঘ ভেসে যাবে অর্থাৎ আপনি মেঘের ভেতর দিয়ে যাবেন। কেবল কারের টিকেট ১১২০ নেপালি রুপি। 


পাহাড়ের চূড়ায় একটি মানমন্দির রয়েছে যেখান থেকে আবহাওয়া ভালো থাকলে হিমালয় পর্বতমালা দেখা যায়। মানমন্দিরে ঢুকতে ৫০ রুপি দিয়ে টিকেট কাটতে হয়। কপাল ভালো থাকলে গৌরিশঙ্কর হিমাল আর এভারেস্ট ভেসে উঠবে আপনার চোখের সামনে। ক্ষুধা লাগলে মানমন্দিরের কাছেই রেস্টুরেন্ট আর আইসক্রিম পার্লার আছে, খেয়ে নিতে পারেন।


পোখারা



নেপাল ভ্রমণ গাইডে আমাদের পরবর্তী শহর পোখরা। পোখরা শহরটি অত্যন্ত সুন্দর একটি শহর। নেপাল ঘুরতে এলে পোখারা যাওয়া আবশ্যকীয়। কাঠমান্ডু থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে পোখরা অবস্থিত। এখানে যাওয়ার উপায় হচ্ছে বাসে করে যাওয়া বা গাড়ি ভাড়া করা। বাসে করে যাওয়া তুলনামূলক সাশ্রয়ী। কাঠমান্ডু থেকে পোখরা যাওয়ার ভালো বাস আছে। যেতে লাগে সর্বোচ্চ ৮ ঘন্টা। সময় বাঁচাতে গাড়িতেও যেতে পারেন। গাড়িতে যেতে ৬ ঘন্টা লাগে কিন্তু ভাড়া তুলনামূলক অনেক বেশি।


পোখরা যাওয়ার সময় রাস্তার দুপাশে পাহাড় দেখা যায় যা মনকে উৎফুল্ল করে তোলে। পোখরার হোটেলগুলো বেশ ভালো, দামও রিজনেবল। বেশিরভাগ হোটেেল থেকে পাহাড় দেখা যায়। পোখরায় স্ট্রিট ফুড ট্রাই করে দেখতে পারেন। খাবার বেশ ভালো। পোখরার বিখ্যাত স্থানগুলো ঘুরে দেখতে চাইলে কমপক্ষে ২ দিন এখানে অবস্থান করুন, ভালো লাগবে।


ফেওয়া লেক



পোখরায় ৩টি লেক আছে যার মধ্যে ফেওয়া হ্রদ অন্যতম। ৩টির মধ্যে যেকোন একটি হ্রদ ঘুরে দেখলেই হয়। ফেওয়া হ্রদের ঠিক মাঝখানে একটি দ্বীপের ওপর তাল বরাহী মন্দির যা দেবতা বিষ্ণুকে উৎসর্গ করা হয়েছে। হ্রদের পানি অনেক পরিষ্কার আর মনোরম দেখতে। বোটে করে হ্রদের পানিতে ঘুরতে ভালো লাগবে। বোটে ঘুরতে খরচ হবে জনপ্রতি ৭০০ টাকা।


সারাংকোট



সারাংকোট হচ্ছে পোখরার বিখ্যাত প্যারাগ্লাইডিং স্পট। প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক এখানে প্যারাগ্লাইডিং করতে আসে। এখানে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালে আপনার মনে হবে রঙবেরঙের পাখি আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে, আসলে তারা মানুষ।


নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার মতো সুন্দর এই জায়গায় আপনিও করতে পারবেন প্যারাগ্লাইডিং। ১৫-২০ মিনিটের প্যারাগ্লাইডিং করতে আপনার খরচ পড়বে ৫,০০০ নেপালি মুদ্রা। সেই সাথে অন-এয়ার অ্যারোব্যাটিকস যোগ করতে চাইলে খরচ করতে হবে আরো এক হাজার নেপালি রুপি।


মহেন্দ্র গুফা



মহেন্দ্র গুফা একটি বিখ্যাত প্রাকৃতিক চুনাপাথরের গুহা যা পোখরার অন্যতম ট্যুরিস্ট আকর্ষণ। গুহার ভেতর একটি শিবমূর্তি রয়েছে আর রয়েছে অনেক অনেক বাদুড়। গুহাটি অন্ধকার আর ভেজা। পর্যটকদের সুবিধার্থে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা রয়েছে। গুহাটি অনেক বড়, এর অর্ধেক পর্যটকদের জন্য খোলা বাকিটুকু বন্ধ আছে। গুহার বাইরে আশেপাশের এলাকা সুন্দর করে সাজানো, গুহার ভেতরে ঢোকার আগ পর্যন্ত সিঁড়ি বসানো।


ডেভিস ফলস



পোখরার আরেকটি বিখ্যাত ট্যুরিস্ট আকর্ষণ ডেভিস ফলস। এই ঝর্ণার উৎস ফেওয়া হ্রদের ড্যাম। ডেভিস ফলসের নামকরণের পেছনে একটি গল্প আছে। ডেভিস নামক এক মহিলা তার পার্টনারকে নিয়ে এই ঝর্ণায় গোসল করতে গিয়ে খাদে পড়ে মারা যান। ৩ দিন পর তার মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায়। তার শোকাহত বাবার ইচ্ছায় ঝর্ণাটির নাম ডেভিস ফলস রাখা হয়। ঝর্ণাটি এখন পোখরার অন্যতম ট্যুরিস্ট স্পট।


নগরকোট



আমাদের নেপাল ভ্রমণ গাইডের সবচেয়ে আকর্ষনীয় জায়গা নগরকোট। এখানে পাহারের কোলে বসানো হোটেলের বারান্দা থেকে হিমালয় দেখা যায় । এমনকি হোটেল রুমে শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়েও আপনি হিমালয় দেখতে পাবেন । শুধুমাত্র নগরকোট থেকেই একসাথে হিমালয়ের ৮টি রেঞ্জ দেখা যায় যার মধ্যে এভারেস্ট ও আছে। দূর থেকে হিমালয় পর্বতমালা দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য সবার হয়না। আকাশ পরিষ্কার থাকতে হয় বিশাল এলাকা নিয়ে গঠিত এই পর্বতমালাটি সম্পূর্ণভাবে দেখার জন্য। আর হিমালয় তো শুধু দেখার নয়, অনুভব করারও জিনিস।


পোখরা থেকে কাঠমান্ডু ফিরে এসে নগরকোট যেতে বেশিক্ষণ লাগবে না। বাসে করে যেতে ১ ঘন্টা ৩০ মিনিটের মতো লাগে। নগরকোটে বেশিরভাগ মানুষই রাত কাটাতে যায় যাতে সকাল সকাল সূর্যোদয় দেখা যায়। কিন্তু আমাদের মতে নগরকোটে দুই রাত কাটাতে পারলে ভালো। হিমালয় দেখার সুযোগ যখন পাওয়াই গেছে মনের সাধ মিটিয়ে দেখে নেয়াই ভালো। যারা এক রাত কাটাতে নগরকোট যান তারা প্রায় সবাই ই পরে আফসোস করেন কেন আরেকটু সময় নিয়ে গেলেন না। 


চিতওয়ান ন্যাশনাল পার্ক



চিতওয়ান ন্যাশনাল পার্ক নেপালের সবচেয়ে বড় সংরক্ষিত বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য। এটি একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। নেপাল এর তরাই অঞ্চলে অবস্থিত এই বিশাল পার্কটি ৯৫২ স্কয়ার কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। এখানে ৬৮ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৫৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫৪৪ প্রজাতির পাখি, ও ১২৬ প্রজাতির মৎস্য রয়েছে। বন্য প্রাণীরা এখানে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায়।


নেপাল ভ্রমণে গিয়ে এই পার্কটি ঘুরে দেখতে ভুলবেন না। পার্কে পর্যটকদের জন্য নানারকম বিনোদনের সুযোগ আছে যেমন- হাতির পিঠে চড়া, পাখি দেখা, আশেপাশের গ্রাম ঘুরে দেখা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নদীর তীরে বসে সূর্যাস্ত দেখা ও অন্যান্য। চিতওয়ান পার্কে বিপন্ন পাখি, ভারতীয় গন্ডার ও রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করা হয়েছে যা আসলেই প্রশংসার যোগ্য।


লুম্বিনী



নেপাল ভ্রমণ গাইডে আমাদের সর্বশেষ দর্শনীয় স্থান বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনী। বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের জন্ম নেপালের তরাই অঞ্চলের লুম্বিনী নামক জায়গায়। তাই এটি বৌদ্ধধর্মের অন্যতম তীর্থস্থান ও বটে। এলাকাটিতে বুদ্ধের সময়কার নানান পুরাকীর্তির দেখা পাওয়া যায়। আপনার যদি ইতিহাস ভালো লাগে তবে এই জায়গাটিও ভালো লাগবে। চিতওয়ান পার্ক থেকে লুম্বিনীর দূরত্ব ১৭৪ কিলোমিটার। তাই চাইলে দুটো জায়গা একদিনে ঘুরে আসতে পারেন।


নেপালের বিখ্যাত ট্রেকিং স্পটগুলো



আমাদের নেপাল ভ্রমণ গাইডটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি আমরা নেপালের বিখ্যাত ট্রেকিং স্পটগুলো নিয়ে আলোচনা না করি। নেপাল ট্যুরিজম এর একটি বড় অংশ হিমালয় রেঞ্জে ট্রেকিং। নেপালেই রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে এক্সাইটিং কিছু ট্রেক। এভারেস্ট বেস ক্যাম্প, অন্নপূর্ণা সার্কিট, এবং অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প থেকে শুরু করে ল্যাংটাং, আপার মাসট্যাং– হিমালয় রেঞ্জে রয়েছে বৈচিত্র্যময় সব ট্রেকিং এর রাস্তা। আপনার অভিজ্ঞতা, পারদর্শীতা ও সহনশক্তির ওপর নির্ভর করে আপনি কোন ট্রেকটি বেছে নেবেন।


হিমালয় রেঞ্জে ট্রেকিং করতে গিয়ে আপনি দেখতে পাবেন অসম্ভব সুন্দর স্বর্গীয় কিছু দৃশ্য। এ অনুভূতি বলে বোঝানোর মতো না। তাই তো অভিজ্ঞ ট্রেকাররা বারবার ছুটে যান হিমালয়ে। নতুনদের জন্য ল্যাংট্যাং ও অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প ট্রেকিং তুলনামূলক সহজ। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাস বাদে সারা বছরই কিছু বাছাই করা পথে ট্রেকিং করা যায়। যেসব পথ আবহাওয়ার কারনে বিপদজনক সেগুলো বছরে কয়েক মাসের জন্য খোলে। প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে হিমালয়ে ট্রেকিং করা এখন আগের চেয়ে তুলনামূলক সহজ।


নেপালি খাবার ও অ্যাডভেঞ্চার কার্যক্রম



নেপালিদের আমাদের মতোই ডাল ভাত প্রিয়। নেপালের জনপ্রিয় খাবার নেপালি থালি যাতে ভাত, ডাল, সব্জির তরকারি, মুরগি বা খাসির মাংস থাকে। নেপালিরা আমাদের মতো এত মসলা ব্যবহার করে না কিন্তু তাদের রান্না খেতে ভালো। নেপালের সব জায়গাতেই নেপালি থালি সহজলভ্য, এমনকি হিমালয়ে গিয়েও আপনি নেপালি থালি খেতে পারবেন। এছাড়া নেপালিরা মোমো, সিঙ্গাড়া, নানান রকম পিঠা, ও ডেজার্ট ও পছন্দ করে।



অ্যাডভেঞ্চার প্রত্যাশীরা নেপালে গিয়ে হতাশ হবেন না। প্রত্যেকের জন্যই আছে কিছু না কিছু। সারাংকোটের প্যারাগ্লাইডিং আর ফেওয়া লেকের বোট রাইডিং এর কথা তো বললামই, এছাড়াও আছে রিভার র‍্যাফটিং ও বাঞ্জি জাম্পিং এর সুযোগ।


ত্রিশূলী রিভারসাইড রিসোর্টে পাবেন জনপ্রতি ২,৫০০ নেপালি মুদ্রায় রিভার র‍্যাফটিং করার আকর্ষনীয় সুযোগ। রিভার র‍্যাফটিং করতে গিয়ে প্রথমে একটু ভয় লাগলেও একটু পরেই শুরু হবে এক্সাইটমেন্ট।



নেপালের দ্যা ক্লিফ রিসোর্টে রয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাঞ্জি জাম্পিং পয়েন্ট। এখান থেকে লাফ দেয়ার অভিজ্ঞতা অতুলনীয়।


নেপাল ভ্রমণের উপযুক্ত সময় কখন?


নেপাল ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ সময় শীত শুরু আগে আগে– অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। এই সময় আকাশ পরিস্কার থাকে, উষ্ণ তাপমাত্রা থাকে, সবুজ গাছগাছালি থাকে এবং অনেক দূর থেকেও হিমালয়ের দৃশ্য দেখা যায়।


নেপাল ভ্রমণ খরচ কত লাগে?


মোটামুটি ভালো হোটেলে থাকলে ও সবগুলো দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখলে ৭ দিনের নেপাল ভ্রমণ খরচ জনপ্রতি সব মিলিয়ে ৫০,০০০-৫৫,০০০ টাকা লাগে। এ খরচ কমিয়ে আনা যায় যদি আপনি বাজেট ট্যুরে অল্প কিছুদিনের জন্য নেপাল গিয়ে হোস্টেলে থাকেন ও অল্প কয়েকটি জায়গা ঘুরে দেখেন।  

শেষ কথা


তো এই ছিলো আমাদের নেপাল ভ্রমণ গাইড। আশা করি ব্লগটি আপনার ভালো লেগেছে। ঢাকা টু নেপাল বিমান ভাড়া ২০২২ সম্পর্কে জানতে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন


এই ব্লগটি ভালো লাগলে আমাদের অন্যান্য ব্লগ গুলোও পড়ে দেখতে পারেন।


Related Blogs:


কলকাতা ভ্রমণ গাইডঃ কিভাবে যাবেন ও কোথায় কোথায় ঘুরবেন

ঢাকা থেকে চেন্নাই এর সেরা হাসপাতাল-এ গিয়ে চিকিৎসা নিতে যা যা করা লাগবে

দিল্লী ভ্রমণ গাইডঃ কিভাবে যাবেন ও কোথায় কোথায় ঘুরবেন

বেঙ্গালুরু ভ্রমণঃ দর্শনীয় স্থান ও ভ্রমণ খরচ

সপরিবারে হায়দ্রাবাদ ভ্রমণঃ দর্শনীয় স্থান, ভ্রমণ খরচ ও অন্যান্য

মুম্বাই ভ্রমণঃ দর্শনীয় স্থান ও ভ্রমণ খরচ

কাশ্মীর এর শ্রীনগর ভ্রমণঃ দর্শনীয় স্থান ও ভ্রমণ খরচ

By Rahat Muna

Thinker & Designer

Share This Post :