আন্দামান

আন্দামানে আনন্দ ভ্রমণের খুঁটিনাটি

দিন দিন কবি সাহিত্যিকেরা পৃথিবীর রং-রূপ নিয়ে কতোশতো কবিতা লিখে গেলো! কতো মানুষ ভ্রমণে গিয়ে ফিরে এসেছে সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষ হয়ে, তার কোন ইয়ত্তা আছে! কে যেন লিখেছিলো,

“… তবুও পৃথিবীর কীট হয়ে এখনো সমুদ্র ভালোবেসে

সমুদ্রকে মনে করে তার দ্বিতীয় আবাস…”

 

আসলেই তাই! যুগ যুগ ধরে সমুদ্র-মানুষে কি এক ধরণের অম্ল-মধুর সম্পর্ক তৈরি হয়নি? এই সমুদ্রের কোল ঘেষেই তো জন্ম নিলো সভ্যতা, শুরু হলো অর্থনীতি, ঘুরে গেলো পৃথিবীর চাকা! এই ছোট ছোট দ্বীপের সাথে মানুষের যে বন্ধন- তা অস্বীকার করার কোন উপায় আছে? এখনো মন খারাপ করে কোথাও বসে থাকতে চাইলে ইচ্ছে হয় সমুদ্রের পার ঘেষে একটু বসি। এখনো পরিযায়ী পাখির মতো ঘুরে বেড়াতে চাইলে ইচ্ছে হয় ঘুরে বেড়াই দ্বীপান্তরে। এখনো ইচ্ছে হয় ছুটে যাই এমন কোথাও যেখানে দু’দন্ড শান্তি মিলবে, হাভাতের মতো টাকা খরচ না করেও নিরেট আনন্দ মিলবে। আর এসব একসাথে পেতে যেতে হবে- আন্দামান!


দেশ ছেড়ে যেতে হবে কলকাতা, আর সেখান থেকে আন্দামান ঠিক ২ ঘন্টার ফ্লাইট! কাছাকাছি পৌছাতেই বিমানের জানালায় চোখ রেখে দেখতে পাবেন অদ্ভুত নীল জলরাশি। ওইতো আন্দামান!পৃথিবীর আদিমতম আদিবাসীদের দেশ, কালাপাহারের দেশ! সকালের রোদে চিকমিক করতে থাকা গোটা আন্দামানে চোখ জুড়ে খেলা করবে রাজ্যের বিষ্ময়! পৃথিবীটা এতো সুন্দর কেন? জীবনটা এতো আশ্চর্য ছোট কেন!


৫৭২টা দ্বীপ একসাথে। এর মধ্যে বসতি আছে মাত্র ৩৮টি তে। হাতে সময় বেশি না থাকলে অন্তত ৭ দিনের একটা প্ল্যান করে গেলে ভালো হয়। ঢাকা থেকে কলকাতা ফ্লাইট পেয়ে যাবেন সহজেই। কম খরচে যেতে চাইলে আছে বিভিন্ন বিমান সংস্থা যেমন, রিজেণ্ট এয়ার ওয়েজ, নভো এয়ার, ইউ এস বাংলা ইত্যাদি। খরচ পরবে বাংলাদেশী টাকায় ৫,০০০ থেকে ৮,০০০ টাকা। আগে থেকে প্রস্তুতি নিলে ঢাকা – কলকাতা বিমান টিকিট পাওয়া খুব একটা কঠিন হবে না।


কলকাতা থেকে পোর্ট ব্লেয়ারে নেমে কাছাকাছি হোটেল পাবেন প্রচুর। তবে আগে থেকে বুক না করে গেলে ভোগান্তিতে পড়বার সম্ভাবনাই বেশি। ৮০০ রূপি থেকে শুরু করে ১৫০০০ রূপি পর্যন্ত হোটেল আছে এখানে। তবে সবগুলোই থাকার যায়গা হিসেবে যথেষ্ট নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য।


প্রথম দিন পোর্ট ব্লেয়ারের আশেপাশেই ঘুরতে পারবেন। করভিন’স কোভ সৈকতে পায়চারি, স্থানীয়দের হাকডাকে খানিক ঘোরাঘুরি আর সময় হলে জেট স্কি করতে পারেন। তবে এখানে দুপুরের পর আর বেশি সময় নষ্ট না করাই ভালো। ৪ কিলো দূরে আছে বিখ্যাত সেলুলার জেইল। সেখানে আলো-ছায়ার খেলা না দেখলে বেশ বড়সড় কিছু মিস করবেন- সেটা বাজী ধরেই বলা যায়!


রাতে হোটেল বা স্থানীয় রেস্টুরেন্টগুলোতে ডিনারের ব্যবস্থা আছে। বাঙালি খাবারও এখানে বিভিন্ন হোটেলে পাওয়া যায়। তাছাড়া নিজের পছন্দমতো মেন্যু ঠিক করে রান্না করিয়ে নিতে পারবেন- এই সুবিধাও আছে!


পরের দিন ঘুম থেকে ভোরে উঠতে হবে কিন্তু! যেতে হবে রাধানগর সৈকত। এশিয়ার সেরা সমুদ্রতটে কী না আছে! আরো নিখুঁতভাবে বললে- হ্যাভলক দ্বীপের সৌন্দর্যে মোহিত হবে না এমন মানুষটি পাওয়া দুষ্কর। রহস্যময় সুন্দর এই দ্বীপটিতে যেতে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে রওনা করতে হবে প্রাইভেট ফেরিতে। খরচ পড়বে মোটামুটি ৬০০ থেকে শুরু করে ৬০০০ রূপি পর্যন্ত, ফেরির কোয়ালিটির উপর নির্ভর করে। মোটামুটি দুই-আড়াই ঘন্টার জার্নি। পৌছে দেখতে পাবেন প্রবাল ঘেরা সৈকত। এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে যেতে হবে ছোট ছোট জাহাজে করে। আর এই জাহাজে করে যাবার পথে সমুদ্রের সৌন্দর্যকে নানাভাবে আবিষ্কার করবেন। কখনো সমুদ্রের জলের রঙের পরিবর্তন দেখে অবাক হবেন- কোথাও নীল, কোথাও সবুজ। আবার কখনো মন ভালো করে দেওয়া আকাশই সই! সবুজের সমাহারে হারিয়ে যেতে পারেন চোখ জুড়ানো এলিফ্যান্ড বিচে। কালাপাথর বিচেও ঘুরে আসতে পারেন সেই সাথে!


পোর্ট ব্লেয়ারে ফিরে দেখতে পারেন লং আইল্যান্ড। ডলফিনের খেলা, পরিচর্যা কখন, কীভাবে করা হয়- এসবই দেখতে পারবেন সেখানে। আরো ঘুরে আসতে পারেন বিখ্যাত সেলুলার জেলে। ব্রিটিশদের শাসনামলে তাদের বিরুদ্ধে কথা বললেই সোজা নির্বাসনে পাঠানো হতো এই দূরদ্বীপে। তারপর তাদের ওপর নেমে আসতো সীমাহীন অত্যাচার। ইতিহাসের এসব অভিনব গল্পের সাক্ষী হতে চাইলে পোর্ট ব্লেয়ারের এই জেল মিস করলে চলবে না।


শুধু একদিন সমুদ্রে নেমে কোরাল ও মাছের জগতে প্রবেশের সুযোগ বাদ দেবেন কেন? জল-চশমা পড়ে আর লাইফ রিং হাতের নিচে চেপে ধরে রওনা গভীর ডুব সমুদ্রের গভীরে। একে স্নোরকেলিং বলে। গাইড সঙ্গী হাত ধরে নিয়ে গেল যেখানে রয়েছে কোরালের বেশি বেশি উপস্থিতি সেখানে। জলের নিচে মাথা ডুবিয়ে দেখবেন এক বিস্ময়কর জগত। এত রঙ! এতো রহস্য! এতো সুন্দর! দেখবেন মৃত ও জীবন্ত কোরালের সমাহার। চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা রঙের মাছ। মনে হয় যেন চুমু খাবে এসে। এসব যতোই দেখবেন ততোই নেশা! আশ আর মিটবে না। তবে আশ মিটিয়ে স্নোরকেলিং বা স্কুভা ডাইভিং- যাই করেন না কেন, নিজের পকেটের দিকেও যে নজর রাখতে হবে! দুই হাজার রূপি থেকে শুরু করে দশ হাজার রূপি পর্যন্ত দাম হাঁকা হয় মিনিট পনেরর জন্য।


পরের দিন পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ১০০ কিলো দূরে বারাটাং দ্বীপে চলে যান। সেখান থেকে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার রেডিয়াসের সুবিশাল মাড আগ্নেয়গিরি। স্থানীয়রা একে জাকাই বলে ডাকে। এমনিতে এটা নিষ্কৃয়ই ছিলো, ২০০৪ সালে মহাসাগরীয় ভূকম্পনে এটা আবার জেগে ওঠে। থমথমে পরিবেশ, দেখবেন কোথাও থেকে বুদবুদের মতো গ্যাস বেরিয়ে আসছে। ভয়ংকর সুন্দর দেখে সাবধানেই চলবেন কারন প্রকৃতির রহস্যের যে অভাব নেই!


পোর্ট ব্লেয়ার থেকে নিকোবর যেতে পারেন। যেতে সময় লাগবে পাক্কা ১৬ ঘন্টা! ডিলাক্স কেবিনে এগারো হাজার থেকে শুরু করে সাত হাজার টাকার মধ্যে সেকেন্ড ক্লাস কেবিনেও যেতে পারেন। নিকোবরের কার নিকোবর দ্বীপে বিচিত্র প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীকূল রয়েছে। এছাড়াও পাশাপাশি, একে অরণ্য ও সমু্দ্র তীরভূমির এক আকর্ষণীয় মিলনস্থল বলা চলে। বিস্ময়কর সাদা বালুকাময় সমুদ্রসৈকত এই দ্বীপটিকে এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ পরিভ্রমণীয় পর্যটন স্থলে পরিণত করেছে।


আরো ঘুরে আসতে পারেন কচল দ্বীপে। নিকোবরের বিখ্যাত এই সৈকতের জল স্ফটিকের মতোই স্বচ্ছ। এখানকার স্বাস্থ্যকর বাতাস আর ঢাউস সাইজের নারিকেল আপনার স্বাস্থ্য ফিরাবে বৈকি! সেই সাথে বিশাল সাইজের কাঁকড়া আর গলদা চিংড়ি তো আছেই!


তবে ভ্রমণ সম্পর্কে জেনে রাখা ভালো যে- সব দ্বীপে যেতে দেওয়া হয়না। বিদেশিরা পোর্ট ব্লেয়ারে বীর সাভারকার বিমান বন্দরে নেমেই আন্দামানে প্রবেশের অনুমতি সংগ্রহ করে নিতে পারবেন। অতি অবশ্যই আপনার পাসপোর্ট-ভিসার ডজনখানেক ফটোকপি সাথে রাখবেন। তবে আন্দামানে ঘুরতে হলে আগে থেকেই একটি ট্যুর অপারেটর সংস্থার সাহায্য নিলে ভালো হয়; তারাই বিভিন্ন দ্বীপে যাওয়া এবং থাকার অগ্রিম ব্যবস্থা করে রাখবে।


আন্দামানে যে কয়দিনই ভ্রমণ করেন না কেন- সাথে একটা অতৃপ্তি নিয়েই আপনাকে ফিরতে হবে। পৃথিবীর এই অঢেল সৌন্দর্য্য আমাদের বারবার তা-ই মনে করিয়ে দেয় যে, আমাদের ভেতর এক যাযাবর পথিক বাস করে। সে মুক্তি চায়। সে আবিষ্কার করতে চায়। সে সকল সৌন্দর্য্যকে জয় করতে চায়। ফিরবার বেলায় বিমানের জানালা থেকে যখন শেষবারের মতো নীল জলরাশির দিকে চোখ পড়বে, তখন ঠিক মনে পড়বে- এই এখানে আপনি এর আগেও এসেছিলেন। কোন পূর্বপুরুষের চোখ দিয়ে আপনি ভয়ংকর সুন্দরকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। এখানের আলো-বাতাস-নোনা জল আপনার বহু বছরের চেনা রক্তে বইছে। আন্দামানের এই আনন্দটুকু স্মৃতিপটে বয়ে ফিরে আসার অনুভূতি কী, তা জানার অপেক্ষায় রইলাম!

By Rahat Muna

Thinker & Designer

Share This Post :